বৌদ্ধধর্মে যান মাহাত্ম্য ৩য় খন্ড
তথাগত বুদ্ধের উপরিউক্ত দুইটি উপদেশ থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে ত্রিকালজ্ঞ যোগী আশঙ্কা করেছিলেন তাঁর পরিনির্বাণের পরে তাঁর বাণীর যথেচ্ছ ব্যাখ্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কালক্রমে তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হল। কিন্তু একদিনে হয়নি। এর পরের ঘটনা কুশিনগরে। তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থলে। তখন তিনি সদ্য নিজেকে নির্বাপিত করেছেন বা বলা যায় তিনি সদ্য তাঁর জাগতিক স্থুল দেহ পরিত্যাগ করে নির্বাণ লাভ করেছেন। কিছু ভিক্ষু ক্রন্দনরত। কিছু ভিক্ষু বিলাপরত। কিছু ভিক্ষু শোকাভিভূত। যাঁদের প্রজ্ঞা আরো গভীর হয়েছে এমন কিছু ভিক্ষু তাঁদের শোক সংবরণ করে অধোমুখে তথাগতের দেহের সামনে উপবিষ্ট আছেন। উপস্থিত আছেন মহাস্থবির মহাকাশাপ। তিনি লক্ষ্য করলেন সুভদ্র নামক এক ভিক্ষু ক্রন্দনরত কিছু ভিক্ষুকে বলছেন, – “বন্ধুগণ, ভালই হয়েছে, তোমরা শোক ক’র না, বিলাপ করে না, আমরা এখন সেই মহাশ্রমণ হতে মুক্ত হয়েছি। এ তোমাদের উপযুক্ত, এ তোমাদের উপযুক্ত নয় ইত্যাদি বাক্যবাণে আমরা উপদ্রুত হতাম, এখন আমরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারব, যা ইচ্ছা নয় তাই করব না।” মহাকাশ্যপ দেখলেন সুভদ্রর মুখে শোকের চিহ্নমাত্র নেই। এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত ও চিন্তিত মহাকাশাপ মনে মনে সংকল্প করলেন তথাগতের সমস্ত সূত্র ও বিনয়ের বাণী সংকলিত করবেন। উল্লেখ্য যে এই ঘটনার আগে কোন বাণী লিপিবদ্ধ ছিল না। গুরু শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচারিত হত।
তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পরে আনুমানিক ৫৪২ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ রাজগৃহের সপ্তপর্ণ গুহায় অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় ও মহাস্থবির মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে ত্রিপিটক সংকলনের কাজ শুরু হয়। এই ঘটনাকে ধর্ম সঙ্গীতি বলা হয়। মনে রাখার সুবিধার জন্য তথাগত বুদ্ধ তাঁর বাণী ও উপদেশ ছন্দের আকারে বলতেন। এই ছন্দবদ্ধ ধর্মীয় ভাষ্য নিয়ে যে আলোচনাসভা তাই ধর্ম সঙ্গীতি। আবার পাঁচ শত অর্হৎ ভিক্ষু ও মহাস্থবির মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে একে ‘পঞ্চশতিকা’ ‘ও ‘কাশ্যপ সঙ্গীতি’ নামেও অভিহিত করা হয়। সপ্তপর্ণি গুহায় অনুষ্ঠিত এই সঙ্গীতি ছিল বৌদ্ধ ইতিহাসের প্রথম সঙ্গীতি এবং এই সভায় শুধুমাত্র বিনয়পিটক (ভিক্ষু ও ভিক্ষুনীগনের আচরণবিধি ও পালনীয় নিয়মের সংকলন) ও সুত্রপিটক (ধর্মীয় সূত্রের সংকলন) সংকলিত হয়েছিল। কিন্তু এত কিছু করেও মতভেদ আটকানো গেল না। এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে আমরা জানতে পারি তথাগত বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই সঙ্ঘে মতভেদের মতন ঘটনা ঘটেছিল। কৌশাম্বিতে ধম্মধর ও বিনয়ধর ভিক্ষুদের মতবিরোধ এবং তথাগতের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্ত কর্তৃক সৃষ্ট মতবিরোধ প্রসিদ্ধ ঘটনা। দেবদত্ত সঙ্ঘে ভিক্ষুদের জন্য নতুন নিয়ম চালু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তথাগত বুদ্ধের গভীর ব্যক্তিত্বের কারণে কোন মতবিরোধই আর দানা বাঁধতে পারেনি। অচিরেই বিনষ্ট হয়েছিল।
প্রথম সঙ্গীতির ১০০ বছর পরের কথা, বৈশালীর বজ্জিপুত্ত ভিক্ষুগণ দেবদত্তের মতই ‘দশবথথুনি’ নামে দশটি নতুন নিয়ম চালু করলেন বা বলা যেতে পারে পুরাতন দশটি নিয়মের পরিবর্তন করলেন। তথাগত বুদ্ধের অনুশাসন ছিল কঠোর। তাঁর তৈরি নিয়ম ছিল সূর্য মধ্যগগন থেকে পশ্চিমে হেলতে শুরু করলেই সেদিনের মতন আর খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না। সঙ্গে কিছু সঞ্চয় করা যাবে না। বজ্জিপুত্ত ভিক্ষুগণ বললেন সূর্য পশ্চিমে হেললেও খাদ্য গ্রহণ করা দুই আঙ্গুল পরিমাণ যেতে পারে। সঙ্গে মোষের শিঙে সামান্য একটু নুন সঞ্চয় করে রাখা যেতেই পারে। এইরকম দশটি নিয়মের পরিবর্তন করে তাঁরা “ দশবথথুনি” চালু করলেন। এই মতভেদের মীমাংসার জন্য সঙ্গীতির প্রয়োজন দেখা দিল। এই দ্বিতীয় ধর্ম সঙ্গীতি বৈশালীতে ৪৪২ সাধারণ পূর্বাব্দে সঙ্ঘটিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে সাত শত অহৎ স্থবির সঙ্গীতির কার্য পরিচালনা করেছিলেন এবং এই সঙ্গীতির মূল উদ্দেশ্য বিনয় সংশোধন ছিল বলে একে “সপ্তশতিকা সঙ্গীতি” ও “বিনয় সঙ্গীতি” নামেও অভিহিত করা হয়। যাই হোক, আট মাস ধরে চলা এই সঙ্গীতিতে বজ্জিপুত্ত ভিক্ষুগণ নিন্দিত হলেন এবং সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁদের তৈরি “দশবথুনি” বিনয় বহির্ভূত বলে প্রত্যাখ্যান করা হল। আশ্চর্যের কথা, সামান্য মতভেদের মীমাংসা করার জন্য ভিক্ষুগণকে আট মাস ধরে আলোচনা করতে হয়েছিল! কিন্তু এত কিছু করেও মতভেদ আটকানো গেল না।
এই ঘটনার কিছুদিন পর দশ সহস্রাধীক ভিক্ষু কৌশাম্বী অঞ্চলে এক মহাসভায় মিলিত হলেন। এই সভায় বিনয় পিটকের কিছু নিয়ম পরিবর্তন করে নতুন করে সংকলিত করা হল। এছাড়াও সূত্র পিটকের কিছু বাক্যের অর্থ অন্য অর্থে আরোপ করে নতুন করে সংকলিত করা হল। যদিও এই সভাকে সঙ্গীতির মর্যাদা দেওয়া হয় না তবুও দেখা গেল এই সভায় উপস্থিত ভিক্ষুগণ দলে ভারী এবং তাঁরা নিজেদের ‘মহাসাংঘিক’ নামে অভিহিত করলেন। তাঁদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প এবং এই সভা বর্জনকারী ভিক্ষুগণ স্থবিরবাদী’ বা ‘থেরবাদী’ নামে অভিহিত হলেন। আশ্চর্যের বিষয় যে তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের মাত্র ১০০ বছর পরে এইভাবে ভিক্ষুগণ দুটি দলে ভাগ হয়ে গেলেন। মহাসাংঘিক ভিক্ষুগণ দলে ভারী হওয়ার কারণে প্রবল উৎসাহে তাঁদের মতবাদ প্রচার করতে আরম্ভ করলেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও নতুন নতুন দার্শনিক মতবাদ যুক্ত হতে থাকল। যদিও পরবর্তীকালে থেরবাদীগণ এগারোটি উপদলে ও মহাসাংঘিকগণ সাতটি উপদলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন।