বৃন্দাবনের দোলযাত্রা এবং ভগবান শিব
আমাদের চিরকালীন প্রেমিক দেবতাটির দুষ্টুমির উৎসব। নন্দগাঁও থেকে দলবল নিয়ে কৃষ্ণ যেতেন রাধারাণীর গ্রাম বরসানাতে, দোল খেলতে। তারপর কি হতো, জয়দেব গোস্বামীর পদাবলী থেকে আরম্ভ করে হাজার কবির গানে তার অপর্যাপ্ত বর্ণনা আছে, এবং সেসব বর্ণনার অনেকটাই আদিরসাত্মক… এবং এখানেই দোলযাত্রা বা হোলির (দুটি উৎসবই এখন এক হয়ে গেছে) মাহাত্ম। এই উদ্দামতায়। যৌবনের আত্মনির্ঘোষে। বসন্তের ফিরে আসায়।
শৈবশাস্ত্র অনুযায়ী, ভগবান মহাদেব তাঁর ধ্যানভঙ্গ করার অপরাধে কামদেব মদনকে তৃতীয় নয়নের আগুনে ভস্মীভূত করেছিলেন। কিন্তু মুহূর্তের সেই রোষ প্রশমিত হবার পর তিনি উপলব্ধি করেন যে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। বেচারা মদন সদুদ্দেশ্যে পার্বতীকে সাহায্যই করছিলেন, মহেশ্বরের ধ্যান ভাঙিয়ে তাঁর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। শিব দেখলেন, স্বামীর এই দশার জন্য মদনের স্ত্রী রতি এবং স্বয়ং পার্বতীও ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তারপর যখন রতি চল্লিশ দিন ধরে কঠিন তপস্যা করলেন স্বামীর জীবন ফিরে পাবার জন্য, তখন আর ভোলানাথ পারলেন না। পুনর্সঞ্জীবিত করলেন ‘অনঙ্গ’ মদনকে। মদনভস্মের চল্লিশ দিন পরের সেই দিনটিই নাকি বসন্ত পঞ্চমী, যেদিন কামদেবের পুনর্জীবনপ্রাপ্তি হয়। তাই সেদিন বসন্ত উৎসব, কামের অর্চনা। উৎসবটি কবে, কিভাবে দোলপূর্ণিমার সঙ্গে একাকার হয়ে গেলো, তা বলা কঠিন। প্রাচীন ভারতে এ উৎসব অত্যুৎসাহে পালিত হতো বলে শোনা যায়। হবে না-ই বা কেন? এমন মধুর রসসিক্ত উৎসবকে বাধা দেওয়ার জন্য তো তখন সংস্কৃতির চৌকিদাররা ছিলো না। সম্ভবত মানুষের মনে এত ঘৃণা, বিদ্বেষ, ছুঁৎমার্গও ছিলো না। সে সব অনেক পরের কথা। আজ থেকে সাড়ে চারশো বছর আগে সম্রাট আকবর যখন এই আক্ষরিক অর্থের মিলনোৎসবটির পুনর্প্রচলন করার চেষ্টা করেন, ততদিনে ভারতবর্ষের জনমানসকে চেপে ধরেছে ঘৃণা-বিদ্বেষ-অবিশ্বাসের ফাঁস।