হরতাল আজও প্রতিবাদের একটি বড় অস্ত্র। জেনে নিন ভারতবর্ষের প্রথম হরতাল কোথায় কিভাবে কেন হয়েছিল। মোবাইলে পড়ার জন্য স্ক্রল করুন নি...

ভারতের প্রথম হরতাল

সারা বিশ্বের শােষিত মানুষের কাছে ধর্মঘট বা হরতাল আজও দাবী আদায় অথবা প্রতিবাদ করবার একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত কৌশল। আজকের পরিস্থিতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই প্রশ্নটা যে, ভারতের মাটিতে প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট কবে হয়? ভারতের ধর্মঘটের ইতিহাসচর্চা করলে আমরা জানতে পারবাে, ভারতের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট হল কলকাতার বুকে পাল্কি বেয়ারাদের ধর্মঘট। তাও এক-আধ দিন নয় মশায়, একটানা একমাস। কবে জানেন? আজ থেকে ১৯৫ বছর আগে, ১৮২৭ সালে। ভাবতে পারছেন?কার্ল মার্কস তখন মাত্র নয় বছরের বালক, আরও প্রায় কুড়ি বছর পরে তিনি কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো লিখবেন। শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শ্রমজীবী সমিতি’ তৈরি হতে তখনও তেতাল্লিশ বছর বাকি। ওইদিন থেকেই আরম্ভ হয়েছিল ভারতবর্ষের শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাস। আসুন বিষয়টা সংক্ষেপে জানা যাক। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে কলকাতায় শ্রমজীবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল এই পাল্কি-বেয়ারারা। উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে পাল্কিই ছিল প্রধান গণ-পরিবহণ। অন্ততঃ সমাজের উচ্চবর্গের ক্ষেত্রে তাে বটেই। সাধারণ মানুষদের জন্য ছিল গরুর গাড়ি। সে যাইহােক, ১৮২৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রােষানলে পড়লাে এরা। পাল্কি- বেয়ারাদের উদ্দেশ্যে কোম্পানী জারি করল এক নতুন নির্দেশ। কি সেগুলাে?

(১) প্রত্যেক পাল্কি-বেয়ারাকে পুলিশের খাতায় নাম লেখাতে হবে। (২) প্রত্যেক পাল্কি-বেয়ারাকে বাধ্যতামূলকভাবে পরতে হবে সংখ্যা নির্দেশক চাকতি। (৩) ঘন্টা অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণ করা হবে। প্রকৃতপক্ষে এই আইনের মাধ্যমে কৌশলে পাল্কির ভাড়া কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পাল্কি-বেয়ারারা কিন্তু এই নুতন শ্রমিক-বিরােধী আইন সহজে মানতে পারলেন না। মে মাসে কলকাতা ময়দানে পাল্কি-বেয়ারাদের একটা সমাবেশ ডাকা হল। শ্রমজীবী জনসাধারণের প্রথম সভাটিতে সভাপতিত্ব করলেন সর্দার পাঁচু সুর। আর প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করলেন গঙ্গাহরি। একজন সামান্য বেয়ারার কণ্ঠে শােনা গেল মার্কসীয় রাজনৈতিক স্বর – সরকারি নয়া নীতিতে তাঁদের ক্ষতিই স্বীকার করতে হবে। এই অন্যায় জুলুম কখনও মেনে নেওয়া যায় না। এ আঘাত শ্রমজীবী মানুষের রুজি- রােজগারের বিরুদ্ধে৷ ন্যায্য খাটুনির বিনিময়ে সরকার নতুন আইন করে পাল্কি-বেয়ারাদের নতুন মজুরি বেঁধে দিতে চেয়েছেন। আর গােটা মজুরির একটা অংশ সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে। আজকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারলে, পরবর্তীকালে শােষণের আরও নুতন নুতন কায়দা সে প্রয়ােগ করবে শ্রমজীবী মানুষের উপর।

পাল্কি-বেয়ারাদের এই সভায় মাঝি, মাল্লা, গাড়ােয়ান সমেত অন্যান্য পেশার শ্রমজীবী মানুষেরাও উপস্থিত ছিলেন। মাঝি-মাল্লাদের নেতা ‘ তিনকড়ি’ সেদিনকার দেওয়া ভাষণে আগামী দিনে শ্রমিক সংগঠনের সম্ভাবনার কথা ঘােষণা করেছিলেন। তিনি সমস্ত শােষিত শ্রমজীবী শ্রেণীর স্বার্থে এই আন্দোলনের দ্বারা শিক্ষা নেওয়ার কথা উল্লেখ করলেন। ‘ভারতে ধর্মঘটের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক বাসুদেব মােশেল-এর ভাষায়, “১৮২৭ সালের মে মাসে পাল্কি- বেয়ারাদের দাবীর সমর্থনে সভাটো অনুষ্ঠিত হলেও মাঝি-মাল্লাদের নেতা হিসেবে তিনকড়ির রাজনৈতিক চেতনা ভাবীকালের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করার পক্ষে ছিল প্রথম পদক্ষেপ।” সেদিনের আন্দোলনকারী শ্রমজীবী জনগণ সেখানেই থেমে যাননি, সরকারের নতুন আইনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গণআন্দোলন গড়ে তােলার প্রস্তুতিতে পাল্কি বেয়ারাগণ গণ- স্বাক্ষর সংগ্রহ করে কতৃপক্ষের কাছে দাখিল করবার মতাে আধুনিক চিন্তাভাবনাও তাঁরা করেছিলেন। প্রতিটি এলাকায় পাল্কি-বেয়ারাদের সংগঠন করে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাল্কি-বেয়ারাদের ঐক্যবদ্ধ করে, এমনকি মিছিল পর্যন্ত সংগঠিত করে ফেললেন তাঁরা।

পাল্কি-বেয়ারাদের বিরুদ্ধে প্রবর্তিত নুতন আইনকে কাজে পরিণত করবার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিল কোম্পানী প্রশাসন। কিন্তু প্রশাসনিক হুমকিকে অগ্রাহ্য করে, সংবাদপত্রে সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হবার পাঁচদিনের মধ্যেই হাজার হাজার পাল্কি-বেয়ারা লালবাজারে পুলিশ দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখান। কলকাতার ইতিহাসে সম্ভবত সেই প্রথম সংগঠিত বিক্ষোভ মিছিল। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ধর্মঘটের। ‘ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে গােপাল ঘােষ লিখেছেন, “পালকি বাহকেরা মিছিল করে পুলিশ অফিসে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ আইন ও লাইসেন্স ব্যবস্থার অবসান দাবী করে। তারা সংখ্যায় কয়েক হাজার ছিল। তাদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হলে, সুপ্রিম কোর্টের সম্মুখে এসে জমা হয় এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান দিতে থাকে।” সাথে সাথে এই আইন বাতিলের দাবীতে তারা একটা দরখাস্তও পেশ করলাে। দশ টাকার বিনিময়ে এই দরখাস্তটি লিখে দিয়েছিলেন একজন বাঙালী কেরাণী।

‘পাল্কি-বেয়ারাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটের খবর ছাপা হল সংবাদপত্রে– “Yesterday (21st instant) all the Theeka Bearers of Calcutta had formed themselves into a body and unanimously swore that they would not bear Palankeens until the new Regulation Promulgated for licencing them, be abolished, and that those who would disregard this agreement should be excommunicated from the community forfeiting their caste. A little before twelve they had gathered together and gone directly to Police office arguing against the Regulation referred to. The whole body consisting about 1000 men being however expelled the Police office they afterwards restored the meadow before the Supreme Court and raised loud clamours. The further learn that they have drawn up on English Petition which they intend forthwith to Present to the Supreme Court.” সমাচার দর্পণ-এর মতাে তথাকথিত উদারনৈতিক সংবাদপত্রও পাল্কি-বেয়ারাদের এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধাচারণ করলাে। এর থেকে বােঝা যায় যে, পাল্কি-বেয়ারা ধর্মঘটে ইংরেজ প্রশাসন তাে বটেই, এমনকি সমাজের উচ্চবর্ণের বিত্তবান মানুষেরা কেন সেদিন শ্রমজীবী মানুষের সংগঠিত শক্তির থেকে বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন।

পাল্কি-বেয়ারাদের ধর্মঘট কমপক্ষে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলেছিল। সমাধানের কোন সূত্র পাওয়া যায়নি। পেটের দায়ে শেষপর্যন্ত দরিদ্র বেয়ারাদের নতি স্বীকার করে নিতে হয়। পাল্কি ধর্মঘট ব্যর্থ হলেও শ্রমজীবী আন্দোলনের বিশেষত অসংগঠিত শ্রমিকদের আন্দোলনের ইতিহাসে তা এক স্থায়ী সাক্ষর রেখে গেল। আগামী দিনের শ্রমিক সংগঠনের জন্য তাঁরা এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রেখে গিয়েছিলেন প্রেরণা এবং শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক নীতি ও কৌশল।


লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?

লেখক পরিচয় |

ভালবাসেন লিখতে। ব্যতিক্রমী লেখাতে সিদ্ধহস্ত ৷

Start typing and press Enter to search