বৌদ্ধধর্মে যান মাহাত্ম্য ৪র্থ খন্ড
এবার আসি হীনযান ও মহাযান প্রসঙ্গে। হীনযান বলে প্রথমে কিছুই ছিল না। আগেই বলেছি প্রত্যেকবুদ্ধযান ও শ্রাবকযান নামে দুইটি যান ছিল। এই দুই যানের উদ্দেশ্যই ছিল নির্বাণের মাধ্যমে নিজের মুক্তির মার্গ নিশ্চিত করা। মহাসাংঘিকরা শুধুমাত্র নিজের মুক্তিতে সন্তুষ্ট রইলেন না। তাঁরা বুদ্ধের মতন হতে চাইলেন। অর্থাৎ তথাগত বুদ্ধ যেমন নিজের মুক্তির মার্গ নিশ্চিত করে জীব উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন ঠিক তেমনই মহাসাংঘিকরাও বললেন যতক্ষণ পর্যন্ত না সমস্ত জীবের মুক্তি হচ্ছে ততক্ষণ আমরা নির্বাণ প্রাপ্ত হব না। এই বিষয়ে বড়ই গোলযোগের সৃষ্টি হল। থেরবাদীগণ ঘোর আপত্তি করলেন। তাঁরা বললেন, “তথাগত বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের শুধু নিজের নির্বাণের শিক্ষা দিয়েছেন। জীব উদ্ধারের কথা কোথাও বলা নেই, এ বুদ্ধের শিক্ষার বিকৃতি।” থেরবাদীদের এই আপত্তি মহাসাংঘিকরা পাত্তাই দিলেন না। তাঁরা বললেন, “আমরাই ঠিক, তোমরা ভুল। বুদ্ধ ঠিকই শিক্ষা দিয়েছেন, তোমরা বুঝতে পারনি। বুদ্ধ নিজে যা করতেন তাই শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন। বুদ্ধের কথার তোমরা আক্ষরিক অর্থ করেছ, ভাবার্থ করতে পারনি। তোমরা শুধু নিজের নির্বাণের কথা চিন্তা করো। এ নিতান্তই স্বার্থপরতা। আমরা সকল জীবের কথা চিন্তা করি। আমরা মহান। তোমরা হীন।” এরপরেই কালক্রমে মহাসাংঘিকগণ মহাযানী ও থেরবাদীগণ হীনযানী নামে পরিচিত হলেন। কিন্তু কাহিনী এখানেই শেষ হল না।
যত সময় অতিবাহিত হতে থাকল ততই হীনযানীরা বিনয়কে বেশি করে আঁকড়ে ধরলেন। অন্যদিকে মহাযান সম্প্রদায় দিন দিন দার্শনিক তত্ত্বে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠলেন। আদি বৌদ্ধ মতবাদ ও হীনযানীদের কাছে বুদ্ধের যে মানুষী রূপ ছিল তাই লোকোত্তরবাদী মহাযানীদের কাছে পরিবর্তিত হয়ে বুদ্ধ একজন অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন স্বর্গবাসী হয়ে উঠলেন। আবার দার্শনিকতার সৌন্দর্য দেখুন, হীনযানীদের কাছে জগৎ মিথ্যা। কারণ এই জগতের সমস্ত কিছুই ক্ষণভঙ্গুর বা ক্ষণস্থায়ী। মহাযানীরা বললেন জগৎ যদি মিথ্যা হয় তাহলে দ্রষ্টা অর্থাৎ যিনি দেখছেন (তিনিও এই জগতের অঙ্গ) তিনিও মিথ্যা। সাধারণ দ্বিতীয় শতকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও দার্শনিক নাগার্জুনের আবির্ভাব ও তাঁর শূন্যবাদ (বস্তুসারের বিপরীতে বস্তুশূন্যতা) দর্শনের ফলে মহাযান সম্প্রদায়ে এক গভীর বিপ্লবের সূচনা হল। নাগার্জুন রচিত ‘মাধ্যমকবৃত্তি মহাযানের প্রথম গ্রন্থ। যদিও কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে নাগার্জুনই মহাযান মত প্রবর্তন করেন কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয় বলেই মনে হয়। নাগার্জুনের দুই পুরুষ আগে অশ্বঘোষ ‘মহাযানশ্রদ্ধোৎপাদসূত্র’ নামক এক গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়াও অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ ও ‘সৌন্দরানন্দ’ এই দুই গ্রন্থে মহাযান মতের প্রভাব স্পষ্টই পরিলক্ষিত হয়। এর থেকে বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না যে অশ্বঘোষের আগেও মহাযান মতের উপস্থিতি ছিল।