প্রাচীণতম সভ্যতা
প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা! কথাটা বললেই তাতে সুমেরীয়, মেহেরগড়, হরপ্পা, মিশর ভিড় করে আসে। কিন্তু এই সব সভ্যতা থেকেও প্রাচীন, প্রায় তাদের প্রপিতামহের বয়সী সভ্যতার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। যা ইতিহাসের নাগাল থেকে বহু যোজন দূরে। গল্পের আটলান্টিস যেন আটলান্টিক ছেড়ে উঠে এসেছে বাস্তবের মাটিতে। তারই জানান দিতে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার কোণে কোণে জিওগ্লিফের ভাষায় শুনিয়ে যাচ্ছে প্রায় লাখ বছরের পুরনো উন্নত সভ্যতার কথা।
মিশর, সুমেরের নানা কোণে পাওয়া লিপিতে অনেক আগেই উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল কোনও অজানা সভ্যতার হাজার বছরব্যাপী স্বর্ণযুগের। খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল অনেক মহান রাজাদের কথা, যাঁদের এত দিন গল্পকথার আড়ালেই রেখে দিয়েছিলেন ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরা। যাঁরা বিশ্বাস করে এসেছেন মানব সভ্যতার বয়স মাত্র ক’ হাজার বছর। কিন্তু এখন সেই ভাবনার ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার মাপুতো বন্দরের দেড়শো কিলোমিটার দূরের ধ্বংসাবশেষ। যার ব্যাপ্তি প্রায় দেড় হাজার বর্গকিলোমিটার। কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটি আসলে প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জোড়া এক উন্নত নগরসভ্যতার অবশিষ্টাংশ। মনে করা হচ্ছে, প্রায় এক লাখ ষাট হাজার থেকে দু’লাখ বছর আগে তৈরি হয়েছিল এই নগর। আরও আশ্চর্য ভাবে, এই এলাকার আশপাশে খোঁজ মিলেছে একগুচ্ছ প্রাচীন সোনার খনির। এই খনির থেকেই সোনা সংগ্রহ করতেন সেই বিস্মৃত অতীতের পূর্বপুরুষেরা। এমনই আন্দাজ গবেষকদের।
তবে ভুরু কোঁচকানোর পালা শুধু আফ্রিকায় শেষ না। যেতে হবে আটলান্টিক পেরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজনের জঙ্গলে। সাম্প্রতিক ভয়ঙ্কর দাবানল বা বেআইনি ভাবে জঙ্গল সাফ করার অভিযোগে সেই আদিম অরণ্য এখন জর্জরিত। কিন্তু এই সাফ হয়ে যাওয়া জঙ্গলেই প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ আর ১০ কিলোমিটার চওড়া এলাকার মধ্যে খোঁজ মিলেছে ইনকা সভ্যতার নাজকা রেখার মতো অসংখ্য জিওগ্লিফের। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট চিত্র থেকে পাওয়া এই দীর্ঘ রেখাগুলি নির্দেশ করছে কোনও প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্বের।
জিওগ্লিফ বলতে বোঝায় উপগ্রহ থেকে ভূপৃষ্ঠে দেখতে পাওয়া নানা মানুষের সৃষ্ট রেখা যা স্বাভাবিক ভাবে ভূমিতে থেকে বোঝা সম্ভব না। এই রেখার এলাকায় পৌঁছে পাওয়া গেছে সময়ের স্রোতে প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া সভ্যতার অবশেষে। তার মধ্যে রয়েছে ২৬০টি চওড়া রাজপথ। সাথে প্রচুর সেচ খাল, যা যোগ হয়েছে অ্যামাজনের মূল স্রোতে। যেগুলির উঁচু করা ধারই জিওগ্লিফ রেখা হয়ে ধরা পড়েছে স্যাটেলাইটের ক্যামেরায়। স্পষ্ট ভাবেই কোনও উন্নত সভ্যতার অস্তিত্বের জানান দেয় এই সমস্ত প্রমাণ। অ্যামাজন জঙ্গলের পশ্চিম দিকে বলিভিয়া আর ব্রাজিলের সীমান্তের আশপাশের এলাকায় মহীরুহের শিকড় এত দিন লুকিয়ে রেখেছিল এই সভ্যতাকে। অ্যামাজনের জঙ্গল বললেই মনে এসে কড়া নাড়ে এল ডোরাডো।
কাল্পনিক হলেও যে জঙ্গলের সমস্ত নিভৃত কোণে পৌঁছতে পারেনি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ, সেখানে প্রকৃতির আপন খেয়ালে চাপা পড়ে আছে কোন অমূল্যরতন, তার ছাই ওড়াবার সত্যান্বেষীদের খোঁজ মেলা ভার। তবে প্রকৃতির মাঝেই মিলেমিশে থাকা কিছু প্রাচীন পিরামিড উসকে দিয়েছে প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্বের জল্পনা। পারাতোয়ারির প্রাকৃতিক নিখুঁত ত্রিভুজাকৃতির পিরামিডগুলিকে আর শুধু প্রকৃতির সৃষ্টি বলে মানতে নারাজ একদল গবেষক। এই নতুন আবিষ্কারের আলোয় এগুলিকে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কীর্তির উপর লাখ বছরের প্রকৃতির প্রলেপ বলেই দাবি করছেন তাঁরা। তাই পেরুর এই মানু এলাকায় এখন গবেষকদের আনাগোনা বেড়েই চলেছে গভীর জঙ্গলের অভ্যন্তরে। ইনকা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের আশপাশে বিস্তৃত এলাকাতেও একই রকম উপগ্রহচিত্রের খোঁজ দিয়েছে নাসা, যা ইনকা সভ্যতার থেকে বহু গুণে প্রাচীন। এ ভাবেই আমাদের লাখ বছর আগের পূর্বপুরুষদের সাথেই মিসিং লিঙ্কের খোঁজে একের পর এক সত্যের সিলমোহরের ছাপ পড়ে চলেছে দিনের পর দিন। এর পর হয়তো পুরাণে পড়া মহিষাসুরের দশ হাজার বছরের তপস্যাকেও কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার আগে দু’বার ভাবতে হবে।