অর্থমনর্থম
ভাবিতেছি লিখিব কিনা। অঙ্গুলি নিশপিশ করিতেছে, কলম বলিতেছে – লিখিয়া ফেল, মস্তিষ্ক ভাবিতেছে নিয়ম বিরুদ্ধ হইবে কি? ‘লেখা’ – তে লিখিবার একটি বড় শর্ত হইল রাজনীতির কূটকচালি মুক্ত লেখা হইতে হইবে। সুতরাং …
সুতরাং লিখিয়া ফেলাই সঙ্গত। সম্পাদকমন্ডলী বুঝিয়া লইবেন।
সমাজে একটি বিষ্ফোরণ হইতেছে। কখনও স্বঘোষিত হইয়া সেই বিষ্ফোরণ আমজনতার কর্ণে পৌছাইতেছে, আবার কখনও নিঃসাড়ে তাহা আমজনতার কর্ণকুহর এড়াইতেছে। কিন্তু কি সেই বিষ্ফোরণ, যাহার এইরূপ দুইটি আপাত বিপরীত চেহারা রহিয়াছে? বিষ্ফোরণটি অর্থের। এ অর্থ আপন অধিকারের অর্জিত অর্থ নহে। এ অর্থের উৎস সংঘটিত অপরাধ। পাঠক প্রশ্ন করিতে পারেন, সংঘটিত অপরাধ কি? উত্তরটি পরে দিতেছি। কিন্তু এক্ষণে ‘গন্ধ’ বিষয়ক একটি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি।
বেশ কিছুদিন যাবৎ সমাজের নানান স্তর হইতে একটি ‘পচা মড়ার’ গন্ধ আসিতেছিল। আমজনতা ইতিউতি ঘাড় নাড়াইয়া গন্ধের উৎসের তালাশ করিতেছিল। এবং সেই তালাশের ফাঁকে ফাঁকে সামনে দিয়া যে চল্লিশ লাখি গাড়িটি ধূল উড়াইয়া রাজকীয় ভঙ্গিমায় চলিয়া গেল, উহার দিকে তাকাইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করিতেছিল… কয়েক বৎসর পূর্বেও গাড়ির মালিকটি ভাঙ্গা সাইকেল ভ্যানের উপর পুরানো পোশাক বিক্রি করিত, দন্তের ফাঁকে প্রজ্জ্বলিত বিড়ি লইয়া নির্নিমেষে তাকাইয়া থাকিত … আর আজ???!!! ধূম, ধূলার সহিত একটি পচা গন্ধের রেশও গাড়িটি রাখিয়া গেল…। যাহাকে ‘তুই’ বলা আমজনতার হক ছিল, সেই মৎস্য-বিক্রেতাই আজ তাহার কাউন্সিলার… দেখা করিতে হইলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লওয়া অত্যন্ত জরুরি, না হইলেই “দাদা ব্যস্ত”…। কখন যেন ‘তুই’ হইয়া গিয়াছে ‘আপনি’। এবং দেখা যাইতেছে আমজনতা নাসিকা হইতে রুমালটি নামাইতেছে না, পচা গন্ধটি বড্ড জ্বালাইতেছে…। একতলা বাড়িটির পার্শ্বে এক ফুট জমি বাড়তি হইবার জন্য যে প্রতিবেশীর সহিত ‘পানিপথের যুদ্ধ’ হইয়াছিল, সেই মহাপুরুষটি নির্দ্ধিধায় বাড়ির পাশের ফাঁকা খাশ জমিটিতে গ্যারাজ বানাইয়া লইলেন কিন্তু প্রশাসনের শ্যেনদৃষ্টি তাহার উপর পড়িল না… তাহা কি তিনি এলাকার দোর্দন্ডপ্রতাপ, প্রখ্যাত ‘সমাজসেবী’টির শালা বলিয়াই…???!!! পচা গন্ধটি আমজনতার নাকে ক্রমশই চাপিয়া বসিতেছিল।
পাঠক প্রশ্ন করিতে পারেন প্রান্তিক মনুষ্যের সমাজের মাথা হইয়া উঠিবার সহিত পচা গন্ধের সম্পর্কটি কি?
আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কটি সহজবোধ্য না হইলেও কিঞ্চিৎ তলাইয়া দেখিলে সম্পর্কটির একটি স্বরূপ বুঝিতে পারা যাইবে। স্বরূপটি হইল ইহা কোন প্রান্তিক মনুষ্যের আপন পরিশ্রম এবং বুদ্ধিবলে সমাজের মুখ্য ব্যক্তিত্বে উন্নীত হওয়া নহে। এ উন্নয়নের পশ্চাতে রহিয়াছে তীব্র লোভ, বিপুল অর্থের হাতবদল এবং নীতিহীনতা-র ত্র্যহস্পর্শ। যে মানুষটি প্রশাসনের একটি অংশ হইয়া উঠিতেছেন প্রায়শই সমাজ সংস্কারক বা স্বার্থহীন সমাজসেবক হিসাবে তাঁহার কোন পরিচিতি নাই। বহু ইতিহাস ঘাঁটিলেও তাহাকে কেহ স্বার্থহীন সমাজসেবকের তকমা দিবেন না। কিন্তু তাঁহার বিশেষ কৃতিত্ব হইল তিনি সঠিক সময়ে ঝোপ বুঝিয়া কোপটি দিয়াছেন, অর্থাৎ সাক্ষাৎ ক্ষমতাশালী না হইয়াও ক্ষমতাশালীর চক্ষু, কর্ণ অথবা বাহু হইয়া উঠিয়াছেন। মস্তক দেহের চালিকাশক্তি। কিন্তু হস্তপদাদি না থাকিলে মস্তক একটি জড়, অথর্ব বস্তু বিশেষ, যাহাকে লইয়া তামাশা করা চলে। অতএব ক্ষমতার দম্ভ এবং প্রয়োগ দেখাইতে হইলে বাহুবলীদের প্রয়োজন সর্ব্বাগ্রে। এবং ইহা এমন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদ যাহার জন্য কোন পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করিতে হয় না, কোন লিখিত পরীক্ষাতেও কলম ভাঙ্গিতে হয় না। শুধুমাত্র ভালো দালালি করিলেই কেল্লা ফতে। অতএব তথাকথিত প্রান্তিক মনুষ্যের সমাজের মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ মিলিল।
জীর্ণ কুটির অচিরেই বৃহৎ অট্টালিকায় পরিবর্তিত হইল। বিড়ি-র স্থান লইল মহতি বিদেশী সিগার। বেশভূষার রং পরিবর্তিত হইয়া মূলতঃ সফেদ রঙের হইল। এবং গলায় উঠিল প্রায় মোটা দড়ির ন্যায় সোনার হার। ‘তুই’ এক্ষনে ‘তিনি’ হইয়া সমাজসেবী তকমা লইলেন। এবং অচিরাৎ আবার এই সমাজের হাত হইতে বাঁচিবার জন্যই পুলিশ ‘বডিগার্ড’ লইলেন। পাঠক খেয়াল করিবেন, দেহরক্ষী নহে ‘বডিগার্ড’, যাঁহারা সামনে এবং পিছনে, উদ্যত অস্ত্র লইয়া সমাজসেবীটির দামি ‘বডি’টিকে ‘গার্ড’ করিতেছেন। ধীরে অতি ধীরে তিনি হইয়া উঠিতেছেন ঈশ্বর।
পরবর্তী অংশে সমাপ্ত