তথাগত বুদ্ধ যখন তাঁর সদ্ধর্মের প্রচার করেন তখন দলে দলে মানুষ এই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হলেও তাঁর প্রচারিত সদ্ধর্ম ছিল মূলত সংঘ ভিত্তিক। সংসারত্যাগী ভিক্ষুগণ সংঘে যোগদান করে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন, শীল পালন ও সাধনার মাধ্যমে নিজের নির্বাণের মার্গ প্রশস্ত করতেন। বিনয়ের যা কিছু নিয়ম তার সবটাই ছিল ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের জন্য। এই ধর্মে গৃহী উপাসকদের করণীয় তেমন কিছুই প্রায় ছিল না। তাঁরা ত্রিশরণ (বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের শরণ) গ্রহণ করতে পারতেন, ভিক্ষুদের দান-দক্ষিণা দিতে পারতেন এবং স্তূপ ও চৈতো ফুল-বাতি প্রদান করে বন্দনা করতে পারতেন। এর বাইরে ধর্মীয় আচরণবিধি প্রায় কিছুই ছিল না। কিন্তু মহাযান দর্শনের বিকাশের ফলে সাধারণ ব্যক্তিরাও ধর্ম পালনে আচরণীয় আরও অনেক কিছু পেলেন। যেমন পারমিতা নামক দশটি আদর্শ, যা সাধারণ গৃহী ভক্তদের কাছে অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনের থেকে সহজতর ছিল। এছাড়াও মহাযান দর্শনের বিকাশের ফলে সাধারণ গৃহী ভক্তগণ তথাগত বুদ্ধের পূজা করার সুযোগ পেলেন। যদিও স্মরণ রাখতে হবে যে বুদ্ধ স্বয়ং ব্যক্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। তাঁর পরিনির্বাণ স্থলে এক শিষ্যের ভবিষ্যতে তাঁকে আর দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপের উত্তরে তথাগত বলেছিলেন, “যিনি দেহরূপী আমাকে দর্শন করছেন তিনি প্রকৃত আমাকে দর্শন করছেন না, যিনি ধর্মকে দর্শন করছেন তিনিই প্রকৃত আমাকে দর্শন করছেন।”

সময় প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে মহাযান মত ক্রমশ দার্শনিক মতবাদে সমৃদ্ধশালী হতে শুরু করল কিন্তু বুদ্ধের গুরুত্ব কমল। ত্রিশরণে যেখানে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ ছিল সেটাই মহাযান সম্প্রদায়ে ধর্ম, বুদ্ধ ও সংঘ হয়ে গেল। অর্থাৎ প্রথম স্থান থেকে অবনমিত হয়ে বুদ্ধ দ্বিতীয় স্থানে এলেন। শুধু তাই নয়, গৌতম বুদ্ধের গুরুত্ব আরও কমতে থাকল যখন একে একে পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধ পূজিত হতে আরম্ভ করলেন। যেমন মামকী, পান্ডরা, তারা, লোচনা ও বজ্রধাত্বীশ্বরী। ষষ্ঠ ধ্যানীবুদ্ধ বজ্রসত্ত্বের শক্তি হলেন বজ্রসত্ত্বাত্মিকা। শুধু তাই নয় পাঁচ ধ্যানীবুদ্ধের পাঁচজন বোধিসত্ত্বও খুব পূজিত হতে লাগলেন। এঁরা হলেন বজ্রপাণি, পদ্মপাণি, বিশ্বপাণি, সমস্তভদ্র ও রত্নপাণি। ষষ্ঠ ধ্যানীবুদ্ধের বোধিসত্ত্ব হলেন ঘন্টাপাণি।

মহাযান দর্শনের প্রধান বিষয় ছিল বোধিচিত্তের জাগরণ বা উন্নতি। বোধিচিত্ত হল চিত্তের এমন এক অবস্থা যা বোধি বা সমাক জ্ঞানলাভে সহায়ক। শূন্যতা ও করুণা এই দুই প্রকার চিত্তের সমার্থক রূপ বোধিচিত্ত। কিন্তু এই মতে নির্বাণ লাভ করা খুবই কঠিন কাজ। কত জন্ম ধরে সাধনা করে সাধনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে কত কত লোকভূমি পেরিয়ে শূন্যের উপর শূন্য, তার উপর শূন্য পার করে তবেই নির্বাণ প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব। তাহলে বিষয়টিকে সহজ করা যায় কি করে? এই চিন্তা থেকে অষ্টম শতকে পাল সাম্রাজ্যের সময়ে পূর্ব ভারতে বিশেষ করে বাংলা ও তার আশপাশের অঞ্চলে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম এবং বজ্রযান, সহজযান, মন্ত্রযান নামে বেশ কয়েকটি যানের উদ্ভব হয়। যদিও অষ্টম শতকে এই যানগুলির প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি পায় তবুও অনেকে অসঙ্গকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রধান প্রচারক বলে মনে করেন। অসঙ্গের আবির্ভাব ৩৫০ সাধারণ অব্দ নাগাদ। তিনি বৌদ্ধধর্মের বিজ্ঞানবাদের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু অসঙ্গের সময়কাল বা তার আগের আগমশাস্ত্রে তন্ত্রের কিছু কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়।

Series Navigation<< বৌদ্ধধর্মে যান মাহাত্ম্য ৪র্থ খন্ডবৌদ্ধধর্মে যান মাহাত্ম্য ৬ষ্ঠ খন্ড >>

লেখাটি আপনার ভাল লেগেছে?