বৌদ্ধধর্মে যান মাহাত্ম্য ৭ম খন্ড
কিন্তু পঞ্চকাম উপভোগ তো সব মানুষই করে, তাহলে সাধনমার্গে এর বিশেষত্ব কী? আমরা সাধারণ মানুষেরা পঞ্চকাম উপভোগ করে পাপকর্মে লিপ্ত হই। কিন্তু গুরুর উপদেশে যখন শূন্যতার অনুভব হয় বা শূন্যতার বোধ হয়, তখন পঞ্চকাম উপভোগে আর পাপকর্ম সঞ্চিত হয় না।
যদিও সহজযানের সঙ্গে মন্ত্রযানের পার্থক্য অতি সামান্যই তবুও মন্ত্রযান একটি আলাদা মত বা পন্থা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মন্ত্রের দ্বারা সুরক্ষা ও মুক্তির যে মার্গ তাই মন্ত্রযান। এই যানে মন্ত্রই প্রধান। কোন সাংকেতিক শব্দ, অক্ষর, চিহ্ন বা এদের সমষ্টি এক একজন দেব-দেবী বা কোন বিশেষ মন্ত্রের বীজমন্ত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্রের বীজমন্ত্র ‘প্রং’। রত্নসম্ভবের ‘র’, অক্ষোভ্যের ‘য়’, অমিতাভের ‘ব’। ‘হেবজ্রতন্ত্রে’ তথাগতের যে বীজমন্ত্র উল্লেখ আছে তা হল ‘ওম আঃ হুম ফট স্বাহা’। মন্ত্রযানে মন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত হয়েছে মুদ্রা। হাতের আঙ্গুলের বা দেহের বিশেষ বিশেষ ভঙ্গিমা বা চিহ্নের সাহায্যে এই মুদ্রাগুলি প্রদর্শন করা হয়। এই বিষয়ে অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে স্বয়ং তথাগত গৌতম বুদ্ধও কিছু বিশেষ মুদ্রায় উপবিষ্ট হয়ে উপদেশ প্রদান করতেন। উদাহরণ স্বরূপ ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রার (পদ্মাসনে বসে দুই হাত বুকের কাছে এনে আঙ্গুলের বিশেষ মুদ্রা) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি আশীর্বাদ করতেন দুটি বিশেষ মুদ্রায়। অভয় মুদ্রা ও চৈতন্য মুদ্রা। এছাড়াও তাঁর অভিবাদন মুদ্রা (দুই হাত বুকের কাছে এনে নমস্কারের ভঙ্গি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মুদ্রা আমরা প্রায় সকলেই কম বেশি অনুসরণ করি। অনেকে ধারণা করেন স্বয়ং তথাগত বুদ্ধই তাঁর উচ্চমননশীল শিষ্যদের জন্যে এই মুদ্রাগুলির মাধ্যমে ইশারায় তন্ত্রের সূচনা করে গিয়েছিলেন। যদিও এই ধারণা সত্য নয় বলেই মনে হয়।
অতি সংক্ষেপে এতক্ষণ বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিকাশ ও ভিন্ন ভিন্ন যান সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করলাম। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে প্রতিটি যানের মধ্যে আচার-অনুষ্ঠান ও মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও প্রত্যেকেই তথাগত বুদ্ধের মূলদর্শন নির্বাণের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে অনেক যান তথাগতের দেখানো নির্বাণকে গ্রহণ করেছে ঠিকই কিন্তু নির্বাণের পথকে পরিহার করে নতুন পথ গ্রহণ করেছে। তথাগত তাঁর প্রচারিত সদ্ধর্মে নির্বাণ লাভের পথ হিসেবে শীল, সদাচার ও অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথ গ্রহণ করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি শিষ্যদের যে কোন চরমপন্থা পরিত্যাগ করে মল্লিম পতিপদা বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলেছিলেন। অর্থাৎ শরীরকে অধিক কষ্ট দেওয়া বা অধিক ভোগবিলাসে লিপ্ত হওয়া এই দুইয়ের বর্জন করতে বলেছিলেন। তাঁর সময়ে নারী ও পুরুষ এক বিহারে অবস্থান করতে পারতেন না এবং ভিক্ষুণীসংঘ প্রতিষ্ঠার পর তথাগত বিভিন্ন কঠোর নিয়মের প্রবর্তন করেন। অথচ কালের প্রভাবে তাঁর দেখানো সেই নির্বাণ লাভ করতে গিয়ে কিছু যান ঠিক উল্টো পথে হেঁটে অবাধ যৌনতা, যথেচ্ছাচার ও মন্ত্র-তন্ত্রকে নির্বাণের মার্গ হিসেবে গ্রহণ করল। এটি একটি মহান ধর্মের অবমাননা বলেই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এখন ধর্মের এই অসংখ্য গলিপথের মধ্যে সঠিক রাস্তা দেখাবেন কে? বুদ্ধ কি আবারও আমাদের সঠিক মার্গ প্রদর্শন করতে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন? হয়তো বা, মৈত্রেয় রূপে।
তথ্যসূত্র:
১। মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন ভিক্ষু শীলাচার শাস্ত্রী মহাবোধি বুক এজেন্সি দ্বিতীয় সংশোধিত সংস্করণ: ২০১৬।
২। বৌদ্ধ দর্শন – রাহুল সাংকৃত্যায়ন চিরায়ত প্রকাশন পঞ্চম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৮ ।
৩। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ডঃ মণিকুন্তলা হালদার (দে) মহাবোধি বুক এজেন্সি– পঞ্চম মুদ্রণ ২০২১।
৪। বৌদ্ধদের দেবদেবী- ডঃ বিনয়তোষ ভট্টাচার্য চিরায়ত প্রকাশন চতুর্থ মুদ্রণ, জুলাই ২০১৫।
৫। বৌদ্ধবিদ্যা – ডঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাবোধি বুক এজেন্সি দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১০।
৬| ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য – জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৪।