বৌদ্ধধর্মে যান মাহাত্ম্য ৬ষ্ঠ খন্ড
বজ্রযান, সহজযান ও মন্ত্রযান এই তিন যানের মধ্যে পার্থক্য অতি সামান্যই। দেব-দেবীর পূজা, তন্ত্র-মন্ত্র, যন্ত্র (যন্ত্র দেবতার প্রতীক। ধাতব পাত বা ভূর্জপত্রে যন্ত্র আঁকা হয়), মণ্ডল (রহস্যময় নকশা) ও বিভিন্ন অদ্ভুত রহস্যময় আচার-অনুষ্ঠান এই যানগুলিতে মোক্ষ লাভের উপায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। শুধু তাই নয় ডাকিনী, যোগিনী, ভৈরব, ভৈরবী, যক্ষিণী, পিশাচী এরাও এই মতের বৌদ্ধগণের উপাস্য হতে শুরু করে। সাধনমালায় উড্ডিয়ান, কামাখ্যা, সিরিহট্ট (শ্রীহট্ট) ও পূর্ণগিরি নামক চারটি স্থানকে তন্ত্রের পীঠস্থান বলে উল্লেখ আছে। এই চারটি স্থানের প্রত্যেকটিতেই বজ্রযোগিনীর পূজা হত। যদিও বর্তমানে তিনটি স্থানের সন্ধান পাওয়া গেলেও উড্ডিয়ানের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার নিকটে আমাদের বিখ্যাত বাঙালী অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী নামক স্থানটি প্রাচীন কালের উড্ডিয়ান।
বজ্রযানে শূন্যকে বজ্র নামে অভিহিত করা হয়। কারণ শূন্য বজ্রের ন্যায় দৃঢ়, সারবান, অচ্ছেদ্য, অভেদ্য ও অবিনাশী। যোগরত্নমালায় বলা আছে –
দৃঢ়ং সারমশৌষীৰ্যমচ্ছেদ্যাভেদ্যলক্ষণম্।
অদাহী অবিনাশী চ শূন্যতা বজ্র উচ্যতে।।
অর্থাৎ শূন্যতাই বজ্র। একে ছেদ করা যায় না, ভেদ করা যায় না, দগ্ধ করা যায় না, বিনাশ করা যায় না, ইহা অতি দৃঢ় ও সারবান।
বজ্রযানীরা এই শূন্যের পূজারি। যে পন্থায় শূন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া যায়, তাই বজ্রযান বা শূন্যযান। বজ্রযানে দেব পূজা ও দেব দর্শনের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। এই মতের উপাসকদের চিন্তাধারা ছিল বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণের দাক্ষিণ্য ও সাহচর্যে মুক্তিলাভ সহজতর হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হল মোহিনী অতীন্দ্রিয়বাদ। অর্থাৎ মোহিনী শক্তি করায়ত্ত করে ইহজগৎ থেকে মুক্তিলাভ করে শূন্যে বিলীন হওয়ার প্রচেষ্টা। মোহিনী শক্তি বিষয়ে বজ্রযানে মারণ (মৃত্যু ঘটানো), মোহন (উচ্চারণ করা), স্তম্ভন (অবশ করা), বিদ্বেষণ (বিদ্বেষবশত ক্ষতি করা), উচাটন (তাড়ানো) এবং বশীকরণ (বশ করা) এই ছয় প্রকার ‘অভিচার’ নামক তান্ত্রিক আচারের কথা জানা যায়। পরবর্তীকালে এই বজ্রযানীরা নিজেদের একটি আলাদা বৌদ্ধ সম্প্রদায় রূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। এই যানের এক বিশেষত্ব হচ্ছে লামাবাদ। কালচক্রযান নামক আরও একটি যান (মত বা পন্থা) এই বজ্রযান থেকে উদ্ভূত। কালচক্রের অর্থ হল ধ্বংসের চক্র। কালচক্র বা ধ্বংসের চক্র থেকে যা রক্ষা করে তাই কালচক্রযান। এই কালচক্রযান পালরাজবংশের সময়ে বাংলায় প্রসারলাভ করে এবং একাদশ শতকে কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করে।
সহজযানীরা মনে করতেন কাঠ-পাথরের দেব-দেবী পুজো করে কোন লাভ নেই। এই যানে প্রধান ভূমিকা হল গুরুর। এই গুরুদের সিদ্ধ বা সিদ্ধাচার্য বলা হত। তিব্বত দেশে সংরক্ষিত আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস থেকে সর্বমোট চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। যাঁদের মধ্যে লুইপাদ ছিলেন সবথেকে প্রাচীন এবং তিব্বতি সাহিত্যে তাঁকে বাংলার মানুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সিদ্ধাচার্যেরা মাথায় বড় বড় চুল রাখতেন কিন্তু দাড়িগোঁফ কামাতেন। আলখাল্লা পড়তেন। খানিকটা বাংলার আউল বাউলদের মতন এদের বেশভূষা ছিল। সিদ্ধাচার্যরা সন্ধ্যাভাষায় গান লিখতেন, পদ রচনা করতেন। সন্ধ্যাভাষার অর্থ হচ্ছে আলো-আঁধারি ভাষা। যা কানে শুনতে এক, কিন্তু তার গভীর অর্থ আরেক। সহজযান বা তান্ত্রিক সহজিয়া বৌদ্ধধর্মে শূন্যতা হল প্রকৃতি ও করুণা হল পুরুষ। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে জগৎ সৃষ্টি। আবার এই পুরুষ (করুণা) ও প্রকৃতির (শূন্যতা) মিলনে উৎপন্ন হয় বোধিচিত্তের, যা এক অনির্বচনীয় মহাসুখকর অবস্থা। এই যানে মূলত যৌনাচারযুক্ত যোগসাধনার মাধ্যমে বোধিচিত্ত লাভ করা হয়। এই দর্শন সম্পূর্ণরূপে দেহতাত্ত্বিক। এই প্রসঙ্গে দারিপাদ বলেছেন –
কিন্তো মন্তে কিন্তো তন্তে কিন্তো রে ঝাণবখানে।
অপইঠানমহাসুহলীণে দুলখ পরমনিবাণে।
শারিক এই উপায়েই পরমপদ প্রাপ্ত হয়ে সংসারে বিচরণ করছেন। তাঁর আত্মপর বোধ নেই।